মাগুরার মহম্মদপুর উপজেলার লক্ষ্মীপুর গ্রামের মানুষ আজ গভীর ক্ষোভে ফেটে পড়েছে। যেখানে একসময় আত্মার মাগফিরাত কামনায় দোয়া-মোনাজাত হতো, সেই পবিত্র কবরস্থানের উপর এখন গড়ে তোলা হয়েছে গরুর গোয়ালঘর! চোখের সামনে দাঁড়িয়ে থাকা গরুর ছবি তুলেছেন প্রতিবেদক নিজেই। এই জঘন্য ঘটনার মূল কেন্দ্রবিন্দুতে উঠে এসেছে সমাজকল্যাণমূলক সংগঠন ‘লক্ষ্মীপুর উদয়ন সংঘ’- এর নাম, যার রেজিস্ট্রিকৃত ১১ শতক জমি বেআইনিভাবে বিক্রি করে প্রায় ১৫ লক্ষাধিক টাকা আত্মসাতের অভিযোগে গ্রামজুড়ে ব্যাপক চাঞ্চল্যের সৃষ্টি হয়েছে।
“জঘন্য অপরাধ করেছি, শাস্তি মাথা পেতে নেব”-
আত্মগ্লানিতে বললেন সাধারণ সম্পাদক টিপু সুলতান
ঘটনার মূল অভিযুক্ত সংগঠনের সাধারণ সম্পাদক মো. টিপু সুলতান শেষ পর্যন্ত মুখ খুলেছেন। তাঁর স্বীকারোক্তিতে উঠে এসেছে লোভ, আত্মীয়চাপ ও কুপরামর্শে পথভ্রষ্ট হওয়ার করুণ চিত্র- যা গ্রামবাসীর ক্ষোভকে আরও ঘনীভূত করেছে।
এত বড় জঘন্য অপরাধ করা আমার জন্য ঠিক হয়নি। রাষ্ট্র, সমাজ ও ধর্মের কাছে আমি অপরাধী। সরকার আমার জন্য যা শাস্তি নির্ধারণ করবে, আমি মাথা পেতে নেব, – বলতে বলতে কেঁদে ফেলেন তিনি।
তিনি আরও বলেন,
এই সমিতির দুই সদস্য-
হাফিজার মোল্লা, যিনি সম্পর্কে আমার মামা, ও ভবঘুরে মকবুল মোল্লা, এই দুজন প্রতিদিন সকাল-বিকাল আমাকে চাপ ও প্রলোভনের মধ্যে রাখতেন। মকবুল পুরো গ্রামেরই অশান্তির কেন্দ্র, তার কাজই হচ্ছে গ্যাঞ্জাম বাধানো। ওদের কুপরামর্শেই আমি আজ সর্বনাশের পথে। আমি একা না, আমাদের প্রিয় ‘উদয়ন সংঘ’ আজ ধ্বংসের মুখে।”
জাল রেজুলেশন তৈরি করে বিক্রি, শিশু কবরের ওপর গরুর গোয়ালঘর!
স্থানীয় সূত্র এবং টিপু সুলতানের স্বীকারোক্তি অনুযায়ী, ২০২৫ সালের ১৫ জানুয়ারি একটি জাল রেজুলেশন তৈরি করে জমি বিক্রির প্রক্রিয়া শুরু হয়। এরপর ৯ এপ্রিল সংগঠনের সভাপতি মো. নজরুল ইসলাম, সহ-সভাপতি শ্রী প্রশান্ত কুমার ঠাকুর, সাধারণ সম্পাদক টিপু সুলতান এবং প্রভাবশালী হাফিজার-মকবুল চক্র নিজেদের ‘আম মোক্তার’ ঘোষণা দিয়ে মোক্তার হোসেন নামের এক ব্যক্তির কাছে জমিটি বিক্রি করেন।
সবচেয়ে মর্মান্তিক তথ্য হলো বিক্রিত জমির একাংশে আজও অসংখ্য শিশু কবর রয়েছে, অথচ সেখানে এখন গরুর গোয়ালঘর নির্মিত হয়েছে!
জমি বিক্রির দলিলে মূল্য উল্লেখ করা হয়েছে মাত্র ৫ লাখ টাকা, অথচ প্রকৃত বিক্রয়মূল্য ছিল ১৫ লাখ ৩০ হাজার টাকা। ক্রেতা নিজেই স্বীকার করেছেন, পুরো অর্থ সরাসরি টিপু সুলতানের হাতেই পরিশোধ করেছেন।
“আমি কিছুই করি নাই, যা বলেছে তাই করেছি”-
প্রতিবাদে সভাপতি নজরুল ইসলাম, সংগঠনের সভাপতি মো. নজরুল ইসলাম বলেন,
টিপু, হাফিজার, মকবুল, প্রশান্ত- ওরাই চালিয়েছে পুরো বিষয়টা। আমি শুরুতেই টিপুকে সাবধান করেছিলাম, কবরস্থানের জমি বিক্রি করিস না, এর ভয়াবহ পরিণতি হবে। কিন্তু তারা শোনেনি। আজ সেই ভয়ঙ্কর বাস্তবতা আমাদের চোখের সামনে।”
“আমার পেনশনও হয়তো আর পাবো না”- ভেঙে পড়েছেন সহ-সভাপতি প্রশান্ত ঠাকুর
সহ-সভাপতি ও অবসরপ্রাপ্ত শিক্ষক শ্রী প্রশান্ত কুমার ঠাকুর বলেন,
লোভে পাপ, পাপে মৃত্যু- এই কথাটার মানে আজ বুঝছি। শিক্ষকতা জীবনের শেষপ্রান্তে এসে এমন একটা কলঙ্কে জড়াব, ভাবিনি। হয়তো পেনশনও আর পাব না।
তিনি জানান, তিনি ইতোমধ্যে নিজস্ব জমি বিক্রি করে ভারতে স্থায়ী বসবাসের প্রস্তুতি নিয়েছেন।
ভারতে আমার ঘরবাড়ি প্রস্তুত, শুধু যাওয়ার অপেক্ষা। কিন্তু এখন মনে হচ্ছে, এই অপরাধের বোঝা নিয়ে সে দেশেও শান্তি পাবো না।
সমাজসেবা অধিদপ্তর বলছে: তদন্ত শেষ পর্যায়ে, দোষীদের শাস্তি নিশ্চিত
মহম্মদপুর উপজেলা সমাজসেবা কর্মকর্তা মো. আব্দুর রব বলেন,
সংগঠনের জমি বিক্রির বিষয়ে লিখিত অভিযোগ পেয়েছি। তদন্ত কার্যক্রম শেষ পর্যায়ে রয়েছে। জেলা সমাজসেবা কর্মকর্তার নির্দেশনায় ঘটনার সত্যতা মিলেছে। দোষীদের বিরুদ্ধে দ্রুত আইনানুগ ব্যবস্থা গ্রহণ করা হবে।
উল্লেখ্য, নিবন্ধিত সমাজকল্যাণমূলক প্রতিষ্ঠানের জমি বিক্রির জন্য সমাজসেবা অধিদপ্তরের অনুমোদন বাধ্যতামূলক। অথচ এই ঘটনার ক্ষেত্রে কোনো সরকারি অনুমতি নেওয়া হয়নি।
“এটা শুধু দুর্নীতি নয়, ধর্মীয় অনুভূতির চরম অবমাননা”-
গ্রামবাসীর বিক্ষোভ
গ্রামবাসীরা একে শুধুমাত্র দুর্নীতির ঘটনা হিসেবে না দেখে, ধর্মীয় পবিত্রতার চরম লঙ্ঘন হিসেবে দেখছেন। তাঁদের মতে, এটি এক ভয়ঙ্কর বিশ্বাসঘাতকতা।
একজন প্রবীণ গ্রামবাসী ক্ষোভ প্রকাশ করে বলেন,
আমরা কখনো ভাবিনি, আমাদের সন্তানের কবরের ওপর গরু বেঁধে রাখা হবে! এটা শুধু অবমাননা নয়, ধর্মীয় অনুভূতির ওপর সরাসরি আঘাত। আমরা এই ঘটনার দৃষ্টান্তমূলক শাস্তি চাই। গ্রামবাসীরা দাবি করেছেন, অবিলম্বে জাল দলিল বাতিল করে জমি সংগঠনের নামে ফিরিয়ে আনতে হবে, দোষীদের বিরুদ্ধে আইনানুগ ব্যবস্থা নিতে হবে এবং সমাজ থেকে চিরতরে তাদের বয়কট করতে হবে।
‘উদয়ন সংঘ’ এখন অবিশ্বাস, অপবিত্রতা ও আত্মঘৃণার প্রতীক এক সময় ‘লক্ষ্মীপুর উদয়ন সংঘ’ ছিল গ্রামের সমাজসেবার কেন্দ্রবিন্দু, বহু উন্নয়নমূলক কর্মকাণ্ডের উৎসস্থল। আজ তার নাম উচ্চারিত হচ্ছে বিশ্বাসভঙ্গ, ধর্মীয় অবমাননা, আত্মসাৎ ও আত্মগ্লানির করুণ ইতিহাস হিসেবে।
প্রশাসনের দ্রুত ও কার্যকর হস্তক্ষেপ ছাড়া এই ঘৃণ্য অপরাধের দৃষ্টান্ত স্থাপন সম্ভব নয়। আর যদি তা না হয়, তবে সমাজের নৈতিক ভিত্তিই চূড়ান্তভাবে ভেঙে পড়বে।